থ্যালাসিমিয়া একটি বংশগত রক্তস্বল্পতা জনিত রোগ। এটি কোন ছোঁয়াচে রোগ নয়। রক্তের ক্যান্সারও নয়। এই আর্টিকেলে আমরা জানবো এ রোগটি কেন হয় এবং এ রোগটি হলে করণীয় কি কি ?
থ্যালাসেমিয়া এর প্রকারভেদ:
রোগীর ব্লাড নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার উপর ভিত্তি করে বা ক্লিনিক্যলি থ্যালাসেমীয়াকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। যেমন,
- থ্যালাসিমিয়া মেজর (অতিমাত্রায়),
- থ্যালাসিমিয়া মাইনর (অল্প মাত্রা), এবং
- থ্যালাসিমিয়া ইন্টারমিডিয়েট (মধ্যম মাত্রা)।
জেনেটিক্যালি থ্যালাসিমিয়া প্রধানত দুই ধরনের। যেমন,
- আলফা থ্যালাসেমিয়া: এই রোগে আলফা গ্লোবিন চেইন উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটে। আলফা গ্লোবিন চেইন হল হিমোগ্লোবিন নামক প্রোটিনের দুটি উপাদানের মধ্যে একটি যা অক্সিজেন পরিবহন করে। আলফা থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের লোহিত রক্ত কণা স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট এবং অল্প অক্সিজেন পরিবহন করতে পারে।
- বিটা থ্যালাসেমিয়া: এই রোগে বিটা গ্লোবিন চেইন উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটে। বিটা গ্লোবিন চেইন হল হিমোগ্লোবিন নামক প্রোটিনের দুটি উপাদানের মধ্যে একটি যা অক্সিজেন পরিবহন করে। বিটা থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের লোহিত রক্ত কণা স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট এবং অল্প অক্সিজেন পরিবহন করতে পারে।
থ্যালাসেমিয়া কেন হয় ?
বাবা ও মা দুজনের থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে সন্তান থালাসিমিয়া রোগী হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
মানবদেহের ২৩ জোড়া বা ৪৬ টি ক্রোমোজোম থাকে।
এ প্রতি জোড়ার অর্ধেক মায়ের আর অর্ধেক বাবার থেকে আসে। ১৬ নং ক্রোমোজোমে থাকে আলফা জিন আর ১১ নং ক্রোমোজোমে তাকে বিটা জিন। আলফা ও বিটা জিন দ্বয় আলফা ও বিটা গ্লোবিন নামক প্রোটিন তৈরি করে যা অনেক অ্যামাইনো এসিডের সমষ্টি। জন্মগতভাবে ১৬ বা ১১ নং ক্রোমোজোমের আলফা এবং বিটা জিন সঠিকভাবে অ্যামাইনো এসিড তৈরি করতে পারে না। ফলে আলফা অথবা বিটা গ্লোবিন নামক প্রোটিন ত্রুটিপূর্ণ হয়। আলফা ও বিটা গ্লোবিন চেইন ত্রুটিপূর্ণ থাকায় লোহিত রক্ত কণিকার হিমোগ্লোবিন ত্রুটিপূর্ণ হয় বলে লোহিত রক্ত কণিকা দ্রুত ভেঙে যায় এবং রক্তস্বল্পতা ও জন্ডিস দেখা দেয়। মানবদেহের যেহেতু জোড়ায় জোড়ায় জিন থাকে তাই একটা জিন ত্রুটিপূর্ণ থাকলে তাকে থ্যালাসেমিয়া বাহক (মাইনোর/ট্রেইট/ হেটারোজাইগোস স্টেট অব থ্যালাসেমিয়া) বলে। আর দুটি জিনই ত্রুটি পূর্ণ থাকলে তাকে থ্যালাসেমিয়া মেজর বা রুগী বা হোমোজাইগোস স্টেট অব থ্যালাসেমিয়া বলে। থ্যালাসেমিয়া বাহক আর থ্যালাসেমিয়া রোগী এক কথা নয়।
থ্যালাসেমিয়ায় কেন রক্তস্বল্পতা থাকে:
লোহিত রক্ত কণিকার মধ্যে হিমোগ্লোবিন (হিম + গ্লোবিন) থাকে বিধায় রক্ত লাল দেখায়। স্বাভাবিক মানুষের লোহিত রক্ত কণিকার গড় আয়ু ১২০ দিন হলেও থ্যালাসেমিয়া রোগের ত্রুটিপূর্ণ গ্লোবিনের কারণে লোহিত রক্ত কণিকার গড় আয়ু মাত্র ২০ থেকে ৬০ দিন। অপরিপক্ক অবস্থায় লোহিত রক্ত কণিকা ভেঙ্গে যায়, তাই রক্তস্বল্পতা ও জন্ডিস দেখা দেয়।
থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ:
থ্যালাসিমিয়ার বাহক স্বাভাবিক মানুষরূপে বেড়ে ওঠে। তাই কেউ থ্যালাসেমিয়ার বাহক কিনা, তা বাহ্যিকভাবে বোঝার কোন উপায় নেই। আর থ্যালাসেমিয়া রোগে জন্মের ৬ মাস বয়স থেকে ফ্যাকাসে হয়ে যায়, জন্ডিস দেখা যায়। পেটের প্লিহা ও লিভার বড় হয়ে যায়। ঠিকমতো শরীরের বৃদ্ধি হয় না।
থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা:
রক্তস্বল্পতার জন্য প্রতি মাসে রক্ত নিতে হয়। ঘন ঘন রক্ত নেওয়ায় ও পরিপাক নালী থেকে আইরনের শোষণ ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় শরীরের আয়রনের মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে লিভার, হৃৎপিণ্ডসহ অন্যান্য অঙ্গের নানা রকম মারাত্মক জটিলতা দেখা দেয়। সঠিক চিকিৎসা ও নিয়মিত রক্ত না নিলে থ্যালাসেমিয়া রোগী মারা যায়। প্রতিবার রক্ত নেওয়া ও আয়রন কমানোর ওষুধ সহ অন্যান্য খরচে একজন থ্যালাসেমিয়া রোগের চিকিৎসায় প্রতিবছর ৫০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়। নিয়মিত রক্ত দিয়ে রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে সঠিক চিকিৎসা করালে থ্যালাসেমিয়া রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হলেও এই রোগের সঠিক চিকিৎসা হলো বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
খাদ্য উপদেশ:
থ্যালাসেমিয়ার বাহক আর রোগীর খাবারের উপদেশ এক নয়। বাহকের খাবার স্বাভাবিক মানুষের মত। আয়রন জাতীয় খাবারের নিষেধ নেই বরং আয়রনের ঘাটতি হলে বেশি বেশি আয়রন জাতীয় খাবার খেতে দিতে হবে। আর থ্যালাসেমিয়া রোগের জন্য আয়রন জাতীয় খাবার কম খেতে হয় এবং প্রয়োজনে শরীর থেকে আয়রন কমানোর ওষুধ নিতে হয়, যা খুবই ব্যয়বহুল। তবে কোনো কারণে আয়রনের ঘাটতি থাকলে অবশ্যই আয়রন জাতীয় খাদ্য ও ওষুধ দিতে হবে।
বংশানুক্রমে কিভাবে থ্যালাসেমিয়া বাহক বা রোগী হয়:

বাবা-মা উভয়ে বাহক হলে প্রতিটি সন্তান জন্মদানে থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার ঝুঁকি শতকরা ২৫ ভাগ। বাহক হওয়ার ঝুঁকি শতকরা ৫০ ভাগ। আর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা ২৫ ভাগ। বাবা, মা যেকোন একজন বাহক হলে প্রতিটি সন্তান জন্মদানে থ্যালাসেমিয়া বাহক হওয়ার ঝুঁকি শতকরা ৫০ ভাগ সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা ৫০ ভাগ। তবে রোগী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। চাচাতো, মামাতো, খালাতো, ফুপাতো ভাই বোনের মধ্যে বিয়ে হলে থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার ঝুঁকে অনেক বেড়ে যায়।
থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে করণীয়:
যেহেতু মা-বাবা দুজনেরই জিনেই বাহক থাকলে সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার ঝুকি থাকে। তাই দুজন বাহকের মধ্যে বিয়ে বন্ধ করাই থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের সবথেকে উত্তম উপায়।
একজন সুস্থ মানুষ যে কাউকে (বাহক বা রোগীকে) বিয়ে করতে পারবে । কারণ তাদের সন্তান রোগী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে একজন বাহক আরেকজন বাহককে বিয়ে না করাই উত্তম। কারণ সন্তানের রোগী হওয়া ঝুঁকি থাকে।
দুজন বাহকের মধ্যে যদি বিয়ে হয়ে যায় বা স্বামী স্ত্রী দুজনেই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হয় তবে বাচ্চা পেটে আসার ৮ থেকে ১৪ সপ্তাহের মধ্যে ক্রওনিক ভিলাস স্যাম্পল বা এমনিওসেন্টেসিস করে বাচ্চার অবস্থা জানা প্রয়োজন। পেটের বাচ্চা থ্যালাসেমিয়া রোগী হলে কাউন্সিলিং করতে হবে যাতে একজন নতুন থ্যালাসেমিয়া রোগীর জন্ম না হয় (গর্ভপাত)। তবে থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে বাচ্চার স্বাভাবিক জন্মদানে কোনো অসুবিধা নেই। তাই বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে প্রত্যেককে জানতে হবে থ্যালাসেমিয়ার বাহক কি না। দুজন বাহকের মধ্যে বিয়ে বন্ধ করা গেলেই থ্যালাসেমিয়া রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
আরোও পড়ুন
আনারসের পুষ্টিগুন। আনারস (Pineapple) কেন খাবেন ?
কিভাবে জানা যাবে কেউ থ্যালাসেমিয়া বাহক কিনা:
হেমাটোলজি অটো এনালাইজার মেশিনে রক্তের সি,বি,সি পরীক্ষায় থ্যালাসেমিয়া বাহকের ধারণা পাওয়া যায়। এরপর হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফরেসিস পরীক্ষা করে থ্যালাসেমিয়া বাহক কিনা নিশ্চিত হওয়া যাবে। তবে ক্ষেত্র বিশেষে ডিএনএ অ্যানালাইসিস পরীক্ষাও করা লাগে। বংশগত রোগগুলো চিকিৎসার চেয়ে সচেতনার মাধ্যমে প্রতিরোধ করাই উত্তম।
উন্নত চিকিৎসা:
থ্যালাসেমিয়া রোগী যাদেরকে অন্যের রক্তের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে হয় তাদের একমাত্র নিরাময় যোগ্য চিকিৎসা হলো ডোনারের অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন বা অ্যালোজেনিক বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট। জিন-থেরাপির ব্যবহার এখনও সীমিত ও পরীক্ষাধীন।
বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টে সুবিধা ও অসুবিধা:
- অস্থি মজ্জা প্রতিস্থাপনে এককালীন বেশি টাকা দরকার হলেও তা সারা জীবনের ব্লাড ট্রান্সমিশন ও চিলেশন চিকিৎসা ব্যয় থেকে অনেক কম।
- সঠিক রোগীদের বেলায় ৮৭ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব ।
- আমাদের দেশে ডোনার রেজিস্ট্রি না থাকায় উপযুক্ত ম্যাচিং বোন ম্যারো ডোনার পাওয়া খুবই দুষ্কর।
- ট্রান্সপ্লান্ট পরবর্তী জটিলতা ও মৃত্যু ঝুঁকি রয়েছে।
- ট্রান্সপ্লান্টে জটিলতা কমাতে ও ভালো ফলাফল পেতে হলে নিয়মিত সঠিকভাবে ব্লাড ট্রান্সমিশন ও ব্লাড ট্রান্সমিশন শুরুর আঠারো মাসের মধ্যে আয়রন চিলেশন শুরু করে আয়রন নিয়ন্ত্রণ এবং লিভার স্বাভাবিক রাখা অপরিহার্য। কারণ দীর্ঘদিন অধিক আয়রনের উপস্থিতি দেহের অনেক অঙ্গ বিশেষ করে লিভার ও হার্টের ক্ষতি করে, যা পরে বোন ম্যারো ট্রান্সমিশনের জটিলতা ও মৃত্যুঝুকি বাড়ায়।
কোন বয়সে বোন ম্যারো ট্রান্সপোর্ট করা উচিত:
এর নিরদিষ্ট কোনো বয়সীমা নেই, তবে দুই বছরের পরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বোন ম্যারো ট্রান্সফার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। অনিয়মিতভাবে ব্লাড ট্রান্সমিশন ও চিলেশন থেরাপি যারা গ্রহণ করে থাকে তাদের বেলায় বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট এর পরিবর্তে ওষুধ দিয়েই চিকিৎসা করা যায়।
অস্থিমজ্জা কে ডোনেট করবে ?
ডোনার হাওয়ার পূর্ব শর্ত হলো এইচ এল এ টিস্যু সম্পূর্ণ অথবা অর্ধেক বা হাফ ম্যাচিং যা মুখের লালা থেকে পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। আপন ভাইবোন যাদের থ্যালাসেমিয়া মেজর বা হিমোগ্লোবিন ই বিটা থ্যালাসেমিয়া নেই তাদের মধ্যে সম্পন্ন এইচ এল এম ম্যাচ (১০/১০, ৮/৮ অথবা ৬/৬) আদর্শ ডোনার হিসেবে গ্রহণ করা হয়। তবে থ্যালাসেমিয়া বাহক (মাইনর) ডোনার হতে পারবেন। যাদের সম্পূর্ণ এইচ এল এ ম্যচ আপন ভাই বোন নেই সে ক্ষেত্রে অর্ধেক ম্যাচ বা হ্যাপ্লো আইডেন্টিক্যাল ডোনার হিসেবে আপন ভাইবোন অথবা বাবা মাকেও নির্বাচন করা যায়। অথবা জাতীয় বা আন্তর্জাতিক রেজিস্ট্রি থেকে নন আত্মীয়ের মধ্যে সম্পন্ন এইচ এল এ ম্যাচ ব্যাক্তিকেও ডোনার হিসেবে নির্বাচন করা যায়। তবে ম্যাচজড অনাত্মীয় ডোনারের চেয়ে ম্যাচজড ভাইবোন ডোনার ভালো ।
কীভাবে অনাত্মীয় ম্যাচ ডোনার পাওয়া যায়:
ব্লাড ব্যাংকে যেমন স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের ব্লাড গ্রুপিংয়ের তালিকা থাকে, তেমনি স্বেচ্ছায় যারা বোনম্যারো স্টেমসেল ডোনেট করতে চায় তাদের এইচএলএ টাইপিং জাতীয় বা আন্তর্জাতিকভাবে বোনম্যারো ডোনার রেজিস্ট্রিতে লিপিবদ্ধ আছে। বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ‘বাংলাদেশ ম্যারো ডোনার রেজিস্ট্রি (BMDR)’ চালু হলেও এর কার্যক্রম খুবই সীমিত।
তথ্যসূত্র : CDC