ড্রাগন ফল
রূপকথা বা কল্পকাহিনির ড্রাগন নয়, এটা জলজ্যান্ত ফল।হ্যাঁ, ড্রাগন ফলের কথাই বলছি।এটি সুস্বাদু ও লোভনীয় ফল।ড্রাগন ফলের জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে। নব্বইয়ের দশক থেকে বাণিজ্যিক ভাবে এই ফলের প্রচলন শুরু হয় এই দেশে। অনেকে একে ‘কমলম’ও বলেন। তাছাড়া ড্রাগন ফল রেড পিটায়া, স্ট্রবেরি পিয়ার, কনডেরেলা প্ল্যান্ট ইত্যাদি নামেও পরিচিত। ড্রাগন ফলের গাছ লতানো, মাংসল, খাঁজকাটা। লোহা, কাঠ বা সিমেন্টের খুঁটি বেয়ে দিব্যি বেড়ে উঠতে পারে। বিদেশি ফল হলেও সুমিষ্ট স্বাদ ও পুষ্টিগুণের জন্য বাংলাদেশেও এখন এই ফলের প্রচুর চাষ হচ্ছে। সচরাচর অন্তত চার রকমের ফল দেখা যায়—লাল বাকল, লাল শাঁস; হলুদ বাকল, সাদা শাঁস; লাল বাকল, সাদা শাঁস; লাল বাকল ও নীলচে লাল শাঁস।শাঁসের ভেতর ছোট ছোট অজস্র কালো বীজ থাকে।ড্রাগন ফলের গাছ চিরসবুজ ক্যাকটাস। ফুল লম্বাটে সাদা এবং অনেকটা নাইট কুইনের মতো দেখতে। ড্রাগন ফলের অনেক ভেষজ ও ঔষধি গুণ রয়েছে।
ড্রাগন ফল এর পুষ্টিগুণ:
প্রতি ১০০ গ্রাম ড্রাগন ফলের পুষ্টি উপাদানগুলি হল:
- ক্যালরি: ১৩৬
- প্রোটিন: ৩ গ্রাম
- কার্বোহাইড্রেট: ২৯ গ্রাম
- ফাইবার: ৭ গ্রাম
- চর্বি: ০ গ্রাম
- ভিটামিন সি: ২১ মিলিগ্রাম (২৮% দৈনিক চাহিদা পূরণ করে)
- ভিটামিন বি৬: ১.১ মিলিগ্রাম (৩১% দৈনিক চাহিদা পূরণ করে)
- পটাসিয়াম: ২৩৫ মিলিগ্রাম (৫% দৈনিক চাহিদা পূরণ করে)
- ম্যাগনেসিয়াম: ১৯ মিলিগ্রাম (৫% দৈনিক চাহিদা পূরণ করে)
- ফসফরাস: ৩১ মিলিগ্রাম (৪% দৈনিক চাহিদা পূরণ করে)
- ক্যালসিয়াম: ১৭ মিলিগ্রাম (২% দৈনিক চাহিদা পূরণ করে)
- আয়রন: ০.৪ মিলিগ্রাম (২% দৈনিক চাহিদা পূরণ করে)
- থায়ামিন: ০.১ মিলিগ্রাম (১% দৈনিক চাহিদা পূরণ করে)
- রিবোফ্লাভিন: ০.১ মিলিগ্রাম (১% দৈনিক চাহিদা পূরণ করে)
- নিয়াসিন: ০.৩ মিলিগ্রাম (২% দৈনিকচাহিদা পূরণ করে)
- ফোলেট: ৬ মাইক্রোগ্রাম (১% দৈনিক চাহিদা পূরণ করে)
- কোলিন: ১০ মিলিগ্রাম
ড্রাগন ফল এর উপকারিতা:

ড্রাগন ফল হল একটি উজ্জ্বল, রঙিন ফল যা পুষ্টিতে সমৃদ্ধ। এটি ভিটামিন সি, ভিটামিন বি৬, পটাসিয়াম, ফাইবার এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। ড্রাগন ফলের রয়েছে অনেক ধরনের উপকারিতা :
কোলস্টেরলের মাত্রা হ্রাস করে:
এ ফল কোলস্টেরল কমিয়ে হার্টকে ভালো রাখতে সাহায্য করে। যাঁরা ওজন কমাতে চান, তাঁদের জন্য এটি ভালো উপায়। এর বীজে আছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, যা আমাদের সুস্থ থাকতে সাহায্য করে। ফলে প্রচুর ভিটামিন ‘সি’, খনিজ লবণ ও আঁশ থাকে। বহুমূত্র, রক্তচাপ ও শরীরের স্থূলতা কমায়। লাল রঙের ফল থেকে চমৎকার প্রাকৃতিক রং পাওয়া যায়। এই রং শরবত তৈরিতেও ব্যবহার্ করা হয়।
ফাইবারের উৎকৃষ্ট উৎস:
ড্রাগন ফলে প্রচুর ফাইবার বা তন্তু থাকে। যুক্তরাজ্যের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ফাইবারযুক্ত খাবার বেশি খেলে কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ বা করোনারি হার্ট ডিজিজের ঝুঁকি কমে। ড্রাগন ফল ডায়েটারি ফাইবারের ভালো উৎস। এটি রক্তচাপ কমাতে ও ওজন কমাতে দারুন কার্যকর। ড্রাগন ফলের আঁশ কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিকারক হিসেবে কাজ করে।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর:
ড্রাগন ফলে প্রচুর ফাইটোনিয়ট্রিয়েন্ট থাকে, যা শরীরে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট জোগাতে সাহায্যকরে।শরীরে ক্ষতিকর ফ্রি র্যাডিকেলসের বিরুদ্ধে লড়তে এটি দারুণ কার্যকর। তাই ক্যানসার বা ত্বকের ক্ষতি ঠেকাতে ড্রাগন ফল খেতে পারেন।
আরোও পড়ুন
থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে আপনার যা কিছু জানা প্রয়োজন
পটাশিয়ামের ভাল উৎস:
ড্রাগন ফলে প্রচুর প্রয়োজনীয় খনিজ উপাদান থাকে। এটি পটাশিয়াম আর ক্যালসিয়ামের দারুণ উৎস যা বিশেষ করে হাড়ের জন্য দরকারি । শরীরের স্নায়ুতন্ত্র ঠিক রাখতেও এর ভূমিকা রয়েছে। জাপানের সিগা ইউনিভার্সিটি অব মেডিকেল সায়েন্সেসের গবেষণা অনুযায়ী, ডায়াবেটিস রোগীদের পটাশিয়ামসমৃদ্ধ খাবার হার্ট ও কিডনি ভালো রাখতে সাহায্য করে।
ডায়াবেটিস কমাতে ড্রাগন:
ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও কমায় ড্রাগন ফল। এটি ফাইবার সমৃদ্ধ হওয়ায়, এটি রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে। এই ফলের নিয়মিত সেবন, রক্তে শর্করার ভারসাম্যতা বজায় রাখতে সহায়তা করে।
গর্ভবতীদের জন্য ড্রাগন:
গর্ভবতী নারীর ক্ষেত্রে উপকারী এই ফল। এতে ভিটামিন বি, ফোলেট এবং আয়রন রয়েছে, তাই এটি গর্ভবতীদের জন্য আদর্শ ফল। ভিটামিন বি এবং ফোলেট নবজাতকের জন্মগত ত্রুটি রোধ করতে সহায়তা করে এবং গর্ভাবস্থায় শক্তি সরবরাহ করে। তা ছাড়া এতে থাকা ক্যালসিয়াম ভ্রূণের হাড়ের বিকাশের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এতে ম্যাগনেসিয়ামও রয়েছে, যা মহিলাদের পোস্টমেনোপজাল জটিলতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করে।
হাড়ের জন্য ড্রাগন:
হাড়ের জন্য ভালো ড্রাগন ফল। এর প্রায় ১৮ শতাংশ ম্যাগনেসিয়াম রয়েছে, যা হাড়কে শক্তিশালী করে তোলে এবং হাড়ের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। ফলে জয়েন্টের ব্যথা, ফ্র্যাকচার কিংবা ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকিও অনেকটাই কমে যায়।
ক্যান্সার প্রতিরোধে ড্রাগন:
ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায় এই ফল। এতে ক্যান্সার বিরোধী বৈশিষ্ট্য বর্তমান। এটি কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে অত্যন্ত সহায়ক। তা ছাড়া এই ফল ভিটামিন সি সমৃদ্ধ, তাই শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে তুলতেও সহায়তা করে। এটি বিভিন্ন দীর্ঘস্থায়ী রোগ যেমন- ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, অ্যালজাইমার এবং পারকিনসন এর মতো রোগের ঝুঁকি কমাতেও সহায়তা করে।
হজম ক্ষমতা বাড়ায় ড্রাগন:
হজমের জন্য ভালো এই ফল। এটি শরীরে ভালো ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে, যার ফলে হজম ক্ষমতাও ভালো হয়। তা ছাড়া এটি ফাইবার সমৃদ্ধ হওয়ায়, পরিপাকতন্ত্রকে ভালো রাখতে সহায়তা করে।
হার্টের জন্য উপকারী:
হার্টের জন্য উপকারী ড্রাগন ফল। এর ক্ষুদ্র কালো বীজগুলো ওমেগা-৩ এবং ওমেগা-৯ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ। এগুলো হার্টের জন্য খুবই ভালো এবং কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ এর ঝুঁকি কমায়। তাই এই ফল খাওয়া হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এটি হার্ট ভালো রাখার পাশাপাশি, রক্তচাপ ও ওজন নিয়ন্ত্রণেও সহায়তা করে।
ত্বক ও চুলের স্বাস্থ্য ভাল রাখতে ড্রাগন:
অস্বাস্থ্যকর জীবনধারা, চাপ, দূষণ এবং খারাপ খাদ্যাভ্যাসের কারণে অকাল বার্ধক্যের সমস্যা আজ খুব সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ড্রাগন ফল ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ হওয়ায়, এটি ত্বককে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল করে তুলতে সহায়তা করে। তাই ত্বকের উজ্জ্বলতা ধরে রাখতে, দিনে একবার এর জুস খেতেই পারেন। এ ছাড়া এটি চুলের জন্য খুব উপকারী।
চোখের জন্য উপকারী:
এটি চোখের জন্যও উপকারী। এতে বিটা-ক্যারোটিন রয়েছে। তাই এই ফল চোখের বিভিন্ন সমস্যা- যেমন ছানি পড়ে যাওয়া এবং ম্যাকুলার ডিজেনারেশন প্রতিরোধে সহায়তা করে।
ড্রাগন ফলের অপকারিতা / পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:

ড্রাগন ফল একটি সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর ফল যা সাধারণত নিরাপদভাবে খাওয়া যেতে পারে। তবে, কিছু লোকের জন্য ড্রাগন ফলের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে, যেমন :
- ডায়রিয়া
- পেট ফাঁপা
- বমি বমি ভাব
- বমি
- মাথাব্যথা
- ত্বকের জ্বালা
- চুলকানি
- অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া
যদি আপনি ড্রাগন ফল খেয়ে এই কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনুভব করেন তবে অবিলম্বে ড্রাগন ফল খাওয়া বন্ধ করুন এবং আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলুন।
ড্রাগন ফলের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এড়াতে আপনি কিছু পদক্ষেপ নিতে পারেন, যেমন:
- ড্রাগন ফল পরিপক্ক হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।
- ড্রাগন ফলকে ভালভাবে ধুয়ে খাবেন।
- ড্রাগন ফলকে পরিমিত পরিমাণে খাওয়ার চেষ্টা করুন।
- যদি আপনার ড্রাগন ফলের প্রতি অ্যালার্জি থাকে তবে এটি খাবেন না।