ডাব ও ডাবের পানি:
ট্রু লাভ ইজ ‘ওয়ান কোকোনাট অ্যান্ড টু স্ট্র’। মানে একটি ডাব আর দুটি স্ট্র-ই হলো সত্যিকারের ভালোবাসা। কথা মন্দ নয়। সামনে নীল জলরাশি রেখে সমুদ্র সৈকতের বালুকাবেলায় দুজন মানুষ একটি ডাব খাবে দুটি স্ট্র দিয়ে, এর চেয়ে রোমান্টিক দৃশ্য আর কী হতে পারে? আর এর স্বাদ? ‘ডেফিনেশন অব টেস্টিং প্যারাডাইস’ বলে একটা কথা আছে ইংরেজিতে। সেটা বলা হয় ডাবের পানির স্বাদ বোঝাতে। বুঝতেই পারছেন, শুধু আপনি নন। পৃথিবীর জনসংখ্যার এক বিশাল অংশের মানুষ ডাবের পানির স্বাদে বিমোহিত হয়ে আছে। কিন্তু কারণটা কী?
স্বাদ বা রোমান্টিকতাই শুধু নয়। ডাবের পানির আছে বিশাল স্বাস্থ্যগুণ। নিয়মিত ডাবের পানি খেলে শরীর হবে বিষমুক্ত। আর ধীরে ধীরে অনেক রোগ দূর হবে শরীর থেকে।
ডাবের পানির পুষ্টিগুণ :
- ক্যালোরি: ২৫০
- কার্বোহাইড্রেট: ২৭ গ্রাম
- চিনি: ১৫ গ্রাম
- ফাইবার: ৪ গ্রাম
- প্রোটিন: ৬ গ্রাম
- চর্বি: ১৪ গ্রাম
- সম্পৃক্ত চর্বি: ১০ গ্রাম
- অসম্পৃক্ত চর্বি: ২ গ্রাম
- বহু অসম্পৃক্ত চর্বি: ২ গ্রাম
- কোলেস্টেরল: ০ মিলিগ্রাম
- সোডিয়াম: ১ মিলিগ্রাম
- ভিটামিন সি: ২০ মিলিগ্রাম
- ভিটামিন বি৬: ১.২ মিলিগ্রাম
- পটাশিয়াম: ৬৫০ মিলিগ্রাম
- ক্যালসিয়াম: ১৫ মিলিগ্রাম
- ম্যাগনেসিয়াম: ৩০ মিলিগ্রাম
- ফসফরাস: ১০০ মিলিগ্রাম
ডাবের পানির উপকারিতা:
তীব্র গরম হোক কিংবা কর্মব্যস্ত দিনের ক্লান্ত সময় হোক, এক গ্লাস ডাবের পানি আপনাকে চনমনে করে দিতে পারে নিমিষেই। তৃষ্ণা মেটাতে কোমল পানীয় কিংবা চিনিমিশ্রিত সরবতের বদলে বেছে নিন এই প্রাকৃতিক পানীয়। বিভিন্ন ধরনের এনজাইম ও খনিজ উপাদানে ভরপুর ডাবের পানি। ক্যালোরি, কার্বোহাইড্রেট, সোডিয়াম, ফাইবার, পটাশিয়াম, ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, আয়রন ও ম্যাগনেশিয়াম মেলে ডাবের পানি থেকে।
ত্বকের যত্নে ডাবের পানি:
প্রাকৃতিক ভিটামিন ও খনিজে ভরপুর ডাবের পানি খেলে ও তা দিয়ে ত্বক পরিষ্কার করলে ত্বকের যে অনেক উপকার হয় সেসব বিষয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে বিভিন্ন দেশে। এটি ত্বকে পানির ভারসাম্য বজায় রাখে এবং আর্দ্রতা ধরে রাখে।ডাবে অ্যামিনো অ্যাসিড ও শর্করা থাকে বলে এটি শুষ্ক ত্বকে পুষ্টি জোগায় ও আর্দ্রতা বজায় রাখে।
ত্বকের ইনফেকশন ও অন্যান্য সমস্যায় ডাবের পানির ব্যবহার বেশ প্রচলিত। ডাবের পানিতে আছে অ্যান্টিফাঙ্গাল ও অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুণ। এছাড়া ডাবের পানি ত্বকের অতিরিক্ত তেলকে দূর করতে ময়েশ্চারাইজার হিসেবেও কাজ করে।
নারীদের রুপচর্চায় ডাবের পানির ব্যাহার:
- নিয়মিত ডাবের পানি খেলে খাবার ভালোভাবে হজম হয়। তাই শরীরের ভেতরে হজম না হওয়া খাবার মেদ হিসেবে জমার সুযোগই পায় না। ফলে ওজন কমতে শুরু করে।
- ডাবের পানি পেট পরিষ্কার রাখে। তাই ব্রণ বা কালো দাগ দূর করে ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
- ডাবের পানিতে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন এ এবং সি, যা ত্বকের জন্য ভীষণ উপকারী এবং চুলের গোড়া মজবুত রাখতে সাহায্য করে।
- ডাবের পানিতে প্রচুর ম্যাগনেশিয়াম ও পটাশিয়াম রয়েছে। তাই ডাবের পানি নখের ভঙ্গুরতা দূর করতে সাহায্য করে। নখের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে।
- নিয়মিত ডাবের পানি খেলে চোখের নিচের কালো দাগ দূর হয়। সেই সঙ্গে চোখের ফোলা ভাব কমায়। ভিটামিন বি কমপ্লেক্স থাকায় ঠোঁট ফাটা ও ঠোঁটের কালচে ভাব দূর করে।
- যাদের অ্যাকনির সমস্যা রয়েছে, তারা ডাবের পানি তুলায় ভিজিয়ে ত্বকের উপর লাগাতে পারেন। তৈলাক্ত বা শুষ্ক যে কোনো ত্বকেই ব্যবহার করতে পারেন এই পানি। ডাবের পানি খেলে মুখের ত্বক আদ্র হয়। পাশপাশি বেশ তরতাজাও দেখায়। তাছাড়া ডাবের শাঁসে যে ক্যালরি রয়েছে তা কর্মক্ষমতা বাড়ায় এবং চেহারায় বয়সের ছাপ পড়তে দেয় না।
ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে ডাবের পানি:
ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণ করতে ডাবের পানি অনেক বেশি কার্যকরী। এতে আছে ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম ও ভিটামিন সি যা ব্লাড প্রেসারকে নিয়ন্ত্রণ করে।
হাড়কে মজবুত রাখতে সহায়তা করে:
হাড়কে মজবুত রাখার জন্য দরকার ক্যালসিয়াম সহ আরো অনেক পুষ্টিগুণ। ডাবের পানিতে যে ক্যালসিয়াম আছে তা হাড়ের জন্য একটি অতি প্রয়োজনীয় উপাদান। এবং আছে ম্যাগনেসিয়াম, যা হাড়কে ভালো রাখতে সাহায্য করে।
গর্ভাবস্থায় ডাবের পানির উপকারিতা:
গর্ভাবস্থায় একজন নারীর অনেক কিছু প্রয়োজন হয় তাঁর নিজের ও সন্তানের জন্য। সে সময় ডাবের পানি কিছু কিছু বিষয়ে বেশ উপকারে আসে।যেমন-
- পটাশিয়াম, সোডিয়াম ও ম্যাগনেশিয়ামের উপস্থিতির কারণে শরীরে ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে।
- পটাশিয়াম থাকার কারনে ডাবের পানি উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করতে পারে।
- ডাবের পানিতে ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম থাকায় এটি ভ্রূণের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
- গ্যাস্ট্রিকের হাত থেকে গর্ভবতী নারীকে স্বস্তি দিতে পারে।
গরমে ডাবের পানির উপকারিতা:
অতিরিক্ত গরমের ফলে শরীরে ঘামের সঙ্গে প্রয়োজনীয় পানি বেরিয়ে যায়। আবার কখনও গরমে বমির ফলেও শরীর পানিশূন্য হয়ে পড়ে। ফলে ডিহাইড্রেশনের মতো সমস্যা দেখা দেয়। ডাবে আছে কার্বোহাইড্রেড যা শক্তি বাড়ায়। এবং শরীরের পানি শূন্যতা পূরণ করে। পটাশিয়াম, সোডিয়াম ও ম্যাগনেশিয়ামের উপস্থিতির কারণে শরীরে ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য বজায় থাকে।
কর্মশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে:
ডাবের পানিতে যে প্রাকৃতিক শর্করা ও মিনারেল রয়েছে তা শরীরকে শীতল ও আর্দ্র রাখে। এজন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যোদ্ধাদের স্যালাইনের বিকল্প হিসেবে ডাবের পানি দেওয়া হতো। এর ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম ও ফাইবার কর্মশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।ডাবের পানি শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেয়। ফলে গরমের সময়ও শরীর সুস্থ ও সতেজ থাকে।
ওজন নিয়ন্ত্রণে ডাবের পানি:
ডাবের পানি খেলে দীর্ঘ সময় পেট ভরা থাকে এবং ক্ষুধার প্রবণতা কমে আসে। ফলে কম খাওয়া হয়। এতে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে। ডাবের পানিতে কোনো চর্বি নেই, বরং এটি শরীরের অতিরিক্ত চিনি শোষণ করে। ফলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেও সহায়ক ডাবের পানি।
হজমশক্তি বৃদ্ধি ও অ্যাসিডিটি থেকে রক্ষায় ডাবের পানির উপকারিতা:
ডাবের পানিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার যা আমাদের পাচনতন্ত্রকে সুস্থ রাখে। হজমশক্তি অনেক বাড়িয়ে তোলে। এছাড়া নিয়মিত ডাবের পানি খেলে অ্যাসিডিটির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে ডাবের পানি:
- ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের জন্য ডাবের পানি বেশ কার্যকর। কেননা এটি ব্লাড সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। এতে থাকা ম্যাগনেসিয়াম ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়ায়।
- কিডনিতে পাথর হওয়া রোধেও ডাবের পানি উপকারী।
- কোলেস্টেরলের মাত্রা কমানো, রক্তচাপের মাত্রা কমানো এবং স্বাভাবিক রাখাতেও এই পানীয়র জুড়ি নেই।
- ডাবের পানিতে প্রচুর পরিমাণ ফাইবার থাকায় কোষ্ঠকাঠিন্যের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়।
- ডাবের পানিতে রয়েছে ডাই-ইউরেটিক উপাদান যা ইউরিনারি ট্র্যাক ইনফেকশনের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়াকে শুধু ধ্বংসই করে না পাশাপাশি শরীরে রোগ প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তোলে।
- ডাবের পানিতে থাকা অ্যান্টি অক্সিডেন্ট দেহকোষ ধ্বংসকারী ফ্রি-র্যাডিকাল থেকেও শরীরকে রক্ষা করে।
- রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধে এর অ্যান্টি- থ্রমবোটিকের ভূমিকা রয়েছে।
শরীরচর্চায় ডাবের পানির উপকারিতা:
যারা নিয়মিত শরীরচর্চা করেন তাদের জন্যও ডাবের পানি খুব উপকারী।ডাবের পানির পটাশিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম হৃদপিণ্ড সচল রাখে এবং ওজন কমাতেও সহায়তা করে। গবেষণা বলে, ব্যায়ামের পর অন্যান্য পানীয়র চাইতে ডাবের পানি অধিক কার্যকর। কেননা এতে প্রচুর পরিমাণ ইলেক্ট্রোলাইটস থাকে। আর এতে থাকা অ্যান্টি-এজিং প্রপার্টি ত্বকের দাগ ও বলিরেখা দূর করে উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে তোলে।
ডাবের পানির অপকারিতা:
প্রতিটি জিনিসের ভালো ও মন্দ দুটি দিকই থাকে। ডাবের পানিরও সেটা আছে। এর কিছু অপকারিতার কথা জেনে নেওয়া যাক-
- ডাবের পানিতে পটাশিয়াম, সোডিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম থাকে। এ উপাদানগুলো শরীরে উচ্চ রক্তচাপ, ইলেকট্রোলাইট, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে। কিন্তু শরীরে এগুলোর মধ্যে শুধু কোনো একটার পরিমাণ বেশি বেড়ে গেলে উচ্চ রক্তচাপ, ইলেকট্রোলাইট, ডায়াবেটিস ইত্যাদির ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। আবার অতিরিক্ত পটাশিয়াম রক্তচাপ কমিয়ে দিতে পারে। এ সবকিছুই স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করবে।
- বলা হয়ে থাকে, কিডনি সুস্থ রাখতে ডাবের পানি পান করা ভালো। কিন্তু কিডনি রোগীদের জন্য ডাবের পানি ক্ষতির কারণও হয় অনেক সময়। কাজেই যাদের যেকোনো পর্যায়ের কিডনি রোগ আছে তাঁরা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ডাবের পানি পান করবেন।
- কোনো কোনো অ্যালার্জির রোগী ডাবের পানি পানে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। কাজেই যাদের অ্যালার্জি আছে তারা চিকিৎসকের পরামর্শে ডাবের পানি পান করবেন।